ভূপৃষ্ঠের কোনো একটি স্থানে g এর মান নির্দিষ্ট, ফলে সেখানে কোনো ব্যক্তির ওজনও নির্দিষ্ট। তা সত্ত্বেও সেখানে কোনো ব্যক্তির ওজনের ভিন্নতা অনুভব করতে পারেন এবং নিজেকে ওজনহীনও মনে করতে পারেন। আসলে ওজন আর ওজন অনুভব করা এক কথা নয়। পৃথিবীতে কোনো ব্যক্তির উপর পৃথিবীর আকর্ষণ বল থাকবেই। ফলে তার ওজন থাকবেই কিন্তু তিনি সেই ওজন অনুভব করবেন কেবলমাত্র তখনই যখন তার ওজনের সমান ও বিপরীতমুখী কোনো প্রতিক্রিয়া বল তার উপর প্রযুক্ত হবে।
আমরা যখন লিফটে চড়ে উঁচু দালানে উঠানামা করি তখন আমরা ওজনের তারতম্য অনুভব করি। আমরা যখন কোনো স্থির লিফটে দাঁড়াই তখন আমরা লিফটের মেঝের উপর আমাদের ওজনের সমান বল প্রয়োগ করি, লিফটও আমাদের উপর ওজনের সমান ও বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়া বল প্রয়োগ করে— আমরা আমাদের ওজনের অস্তিত্ব টের পাই। কিন্তু লিফট যদি উপরের দিকে উঠতে থাকে তখন স্থির অবস্থান থেকে উপরের দিকে যাত্রা করায় লিফটটির উপরের দিকে একটি ত্বরণ সৃষ্টি হয় ফলে লিফটের সাপেক্ষে আমাদের ত্বরণ হয় g এর চেয়ে বেশি। এ বর্ধিত ত্বরণের জন্য আমরা লিফটের উপর আমাদের ওজনের চেয়ে বেশি বল প্রয়োগ করি। তখন লিফটও আমাদের উপর বিপরীতমুখী যে প্রতিক্রিয়া বল প্রয়োগ করে তা আমাদের ওজনের চেয়ে বেশি হয় এবং নিজেদেরকে ভারী অনুভব করি। কিন্তু এরপর লিফট যখন সমবেগে উপরের দিকে উঠতে থাকে তখন তার কোনো ত্বরণ থাকে না, ফলে আমরা আর ওজনের চেয়ে অতিরিক্ত বল অনুভব করি না, কেবল ওজনই অনুভব করি। অপরপক্ষে লিফট যখন নিচে নামতে শুরু করে তখন স্থির অবস্থান থেকে একটি ত্বরণ সৃষ্টি হয় এবং লিফটের সাপেক্ষে আমাদের ত্বরণ g এর চেয়ে কম হয়। এ কম ত্বরণ নিয়ে আমরা লিফটের উপর আমাদের ওজনের চেয়ে কম বল প্রয়োগ করি। ফলে, আমরা হালকা বোধ করি অর্থাৎ আমাদের ওজন কম মনে হয়। লিফট যদি মুক্তভাবে নিচে পড়ে অর্থাৎ, লিফটেরও যদি ত্বরণ হয়, তবে লিফটের g সাপেক্ষে আমাদের ত্বরণ হবে (g - g) অর্থাৎ শূন্য। ফলে আমরা লিফটের উপর কোনো বল প্রয়োগ - করব না। তখন লিফটও আমাদের ওজনের বিপরীতে আমাদের উপর কোনো প্রতিক্রিয়া বল প্রয়োগ করবে না এবং আমরা নিজেদেরকে ওজনহীন মনে করব। কোনো লিফটের কেবল বা দড়ি ছিঁড়ে গিয়ে লিফটটি যদি অভিকর্ষের প্রভাবে নিচে পড়ে তখন এ অবস্থার উদ্ভব হবে। এ অবস্থায় যদি লিফটের ছাদ থেকে ঝুলন্ত বা লিফটে দাঁড়ানো কোনো ব্যক্তির হাতে ধরা স্প্রিং নিক্তি থেকে একটি বস্তু ঝুলিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে দেখা যাবে স্প্রিং নিক্তির কাঁটা শূন্য দাগে অবস্থান করছে। অর্থাৎ, বস্তুটির ওজন শূন্য।
মহাশূন্যযানের পৃথিবী বা চাঁদকে প্রদক্ষিণ করার ও নিকটের মুক্তভাবে নিচে পড়ার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। মহাশূনচারীরা মহাশূন্যযানে করে পৃথিবীকে একটি নির্দিষ্ট উচ্চতার বৃত্তাকার কক্ষপথে প্রদক্ষিণ করে থাকেন। এ বৃত্তাকার গতির জন্য মহাশূন্যযানের দেয়ালের সাপেক্ষে মহাশূন্যচারীর ত্বরণ শূন্য হয় এবং মহাশূন্যচারী মহাশূন্যবাদের দেয়াল বা মেঝেতে কোনো বল প্রয়োগ করেন না। ফলে তিনি তার ওজনের বিপরীত কোনো প্রতিক্রিয়া কাণ্ড অনুভব করেন না। তাই তিনি ওজনহীনতা অনুভব করেন। এ অবস্থায় মহাশূন্যযান থেকে কোনো বস্তুকে ছেড়ে দিলে পড়ে না, গ্রাসের পানি উপুড় করলেও পড়বে না অর্থাৎ সবকিছুই ওজনহীন মনে হবে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কোনো কিছুই এজনহীন হয় না, কেননা ঐ অবস্থানে মহাশূন্যচারীর ভর আছে, ঐ স্থানে অভিকর্ষজ ত্বরণ ৪ লাহে, ফলে পৃথিবীর আকর্ষণ তথা ওজন আছে। কেবল মহাশূন্যযান ৪ স্বরণে গতিশীল হওয়ার কারণে এ আপাতত ওজনহীনতার উদ্ভব হচ্ছে। যদি ঐ স্থানে মহাশূন্যযান বৃত্তাকার পথে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ না করে, বিদ্যা পৃথিবীর দিকে মুক্তভাবে না পড়ে স্থির দাঁড়িয়ে থাকে, তাহলে কিন্তু মহাশূন্যচারী অবশ্যই তাঁর ওজন টের পাবেন।
নতুন শব্দ : মহাকর্ষ, মহাকর্ষীয় ধ্রুবক, অভিকর্ষ, অভিকর্ষজ ত্বরণ, ভর, ওজন ওজনহীনতা, লিফট
এ অধ্যায় পাঠ শেষে যা শিখলাম-
- এ মহাবিশ্বের যেকোনো দুটি বস্তুর মধ্যে যে আকর্ষণ ডাকে মহাকর্ষ বলে।
- মহাবিশ্বের প্রতিটি কতুকণা একে অপরকে নিজের দিকে আকর্ষণ করে এবং এ আকর্ষণ বলের মান বস্তুকণাধরের ভরের গুণফলের সমানুপাতিক - এবং এদের দূরত্বের বর্ণের ব্যস্তানুপাতিক। এ বা কস্তুকণালয়ের সংযোজক সরলরেখা বরাবর ক্রিয়া করে।
- পৃথিবী এবং অন্য যেকোনো বস্তুর মধ্যে যে আকর্ষণ তাকে অভিকর্ষজ বা মাধ্যাকর্ষণ বলে।
- মাধ্যাকর্ষণ বলের প্রভাবে ভূপৃষ্ঠে মুক্তভাবে পড়ন্ত কোনো বস্তুর বেগ বৃদ্ধির হারকে মাধ্যাকর্ষণজনিত ত্বরণ বলে।
- অভিকর্ষজ ত্বরণ বা মাধ্যাকর্ষণজনিত ত্বরণ g-এর আদর্শ মান ৯.৮ মিটার/সেকেন্ড২।
- বস্তুর মধ্যে পদার্থের পরিমাণই হচ্ছে এর ভর।
- কোনো বস্তুকে পৃথিবী যে বল দ্বারা তার কেন্দ্রের দিকে আকর্ষণ করে তাকে বস্তুর ওজন বলে।
আরও দেখুন...